মেলা-নির্ভর লাখো মানুষের রুটিরুজি ঝুঁকিতে
সরকারকে বেকায়দায় ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র অধিকাংশ চেম্বারে স্বৈরাচারের ভূত
- Update Time : ০৮:৫০:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ৫৬ Time View
দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে জনরোষ সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তুলতে দেশের ৫০ টিরও বেশি চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি গভীর ষড়যন্ত্র করছে। এসব চেম্বারে এখনো পতিত স্বৈরাচারের ভূত ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অবিলম্বে ওইসব চেম্বারের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বিপর্যয় অনিবার্য মনে করছেন জাতীয়তাবাদী ঘরানার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, চেম্বার নেতৃত্ব এবং চেম্বার সমূহের সাচিবিক দায়িত্ব সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, নানা ধরনের ফন্দি-ফিকিরে ব্যবসা-বাণিজ্যকে স্থবির করা, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং কারসাজির মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যকে আকাশচুম্বী করে জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার মহান আত্মত্যাগের মহিমাকে মলিন করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। দেশের ক্রান্তিকালে হাল ধরা অন্তর্বরর্তী সরকারকে অচল ও অকার্যকর করার এই হীন ষড়যন্ত্র যেকোন মূল্যে প্রতিহত করতে হবে।
পটপরিবর্তনের পর দেশের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং বিভিন্ন ট্রেড অর্গানাইজেশনের এসোসিয়েশন সমূহের সর্বোচ্চ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি বা ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) – এর শিখরে প্রশাসক নিয়োগ করা হলেও এখন পর্যন্ত শিকরে কোন পরিবর্তন হয়নি।
দেশের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিগুলোর কার্যক্রম অচল হয়ে থাকায় দেশের শিল্প ও বাণিজ্য মেলার আয়ের উপর নির্ভরশীল প্রায় ২৫ লাখ মানুষের রুটি-রুজি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। এই মাধ্যমে আয়ের পরোক্ষ সুবিধাভোগী আরো প্রায় ২৫ লাখ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী শিল্প ও বাণিজ্য মেলা আয়োজনের ক্ষেত্রে চেম্বারের সুপারিশকে আবশ্যিক করা রয়েছে। সুতরাং দেশের বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে স্থবির হয়ে থাকা ব্যবসা-বাণিজ্য সংগঠনের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে ঢেলে সাজানোকে অপরিহার্য বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমান সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রে তৎপর থাকার কারণেও দেশের ৮৪টি চেম্বারের মধ্যে ৫০টিরও বেশি চেম্বারের নেতৃত্বে পরিবর্তন আবশ্যক। দেশে এফবিসিসিআই’র অধিভুক্ত জেলা চেম্বার, মেট্রোপলিটন চেম্বার এবং মহিলা চেম্বার মিলিয়ে মোট ৮৪টি চেম্বার এবং বিভিন্ন ট্রেডের ৪০১টি অ্যাসোসিয়েশন কার্যকর। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর (এ- ক্লাস) চেম্বার ৭০টি এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর (বি- ক্লাস) চেম্বার ১৪টি। আর ৩৯৬টি প্রথম শ্রেণীর (এ- ক্লাস) এবং পাঁচটি দ্বিতীয় শ্রেণীর (বি- ক্লাস) অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। এইসব চেম্বার এবং অ্যাসোসিয়েশনই কার্যত দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি।
পাঁচ আগস্ট পরবর্তীকালে নির্বাচনের মাধ্যমে বৈষম্য বিরোধী চেতনাকে ধারণ করে মাত্র ১১টি চেম্বারে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাদবাকি অধিকাংশ চেম্বার কিংবা অ্যাসোসিয়েশন এখনও দখলে রেখেছে পতিত সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, এমপি, তাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, আওয়ামী লীগ নেতা কিংবা তাদের নিকট-জনেরা। যদিও এদের প্রায় সকলেই পলাতক। আত্মগোপনে থেকেই তারা তাদের দ্বারা অতীতের সুবিধাভোগী আস্থাভাজন পরিচালনা পর্ষদকে দিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যকে অচল করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। কোথাও কোথাও ব্যবসা-বাণিজ্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখারও প্রচেষ্টা বহাল রেখেছে।
জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতা এফবিসিসিআইয়ের একাধিকবারের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ পরিচালক এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বারের নবনির্বাচিত (পুননির্বাচত) প্রেসিডেন্ট আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, চেম্বারসমূহের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইতে প্রশাসক নিয়োগ করা হলেও এখনো পঞ্চাশটির অধিক চেম্বার আওয়ামী লীগের দখলে। অধিকাংশ জেলার চেম্বারে বর্তমান সরকার বিরোধী লোক থাকায় দেশের দ্রব্যমূল্যসহ সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে অসহযোগিতা প্রকট হয়ে উঠেছে। বৈষম্য বিরোধী চেতনাকে যারা গ্রহণ করতে পারেনি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে তারাই ভূমিকা রাখছে। সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন ও অস্থিতিশীল করার কাজ করছে। আওয়ামী লীগের পারপাস সার্ভ করার জন্য তারা এখনো সক্রিয়। তিনি বলেন, খুব কম সংখ্যক চেম্বারে দলনিরপেক্ষ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার লোক রয়েছে।
ওয়াহেদ বলেন, চেম্বার সমূহের ৫ আগস্টের পূর্বের নির্বাচিত পরিচালনা পর্ষদগুলোকে অবিলম্বে ভেঙ্গে দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ করতে হবে। বিগত ১৬ বছর রাজনৈতিক বিবেচনায় অসংখ্য যোগ্য ব্যবসায়ীকে চেম্বারের সদস্যপদ দেয়া হয়নি। যারা বিএনপি-মনা, কিংবা আওয়ামী মতাদর্শের বাইরের তাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। এই মুহূর্তে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যকে গতিশীল করতে যেসব চেম্বারে সম্ভব সেখানে জাতীয়তাবাদী চেতনার এবং সাধারণ ব্যবসায়ীদের সভার মাধ্যমে একটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করা জরুরী। চেম্বারের বিধি-বিধান অনুসরণ করে স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে।
যেসব চেম্বারে অ্যাডহক কমিটি গঠন সম্ভব নয়, সেখানে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে যোগ্যদের সদস্যপদ এবং ভোটাধিকার নিশ্চিত করে নির্বাচনের মাধ্যমে চেম্বারের নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলেন জনাব ওয়াহেদ। সম্প্রতি নাটোর চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে বেশ কয়েক বছর পর জাতীয়তাবাদী চেতনার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চেম্বার প্রেসিডেন্ট হয়ে ফিরে এসেছেন চেম্বার নেতৃত্বে দীর্ঘকালের অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী বান্ধব ও দক্ষ ব্যক্তিত্ব মোঃ আব্দুল মান্নাফ।
তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের যে চেতনা, তাকে কোনভাবেই নস্যাৎ করতে দেয়া যাবে না। ব্যবসায়ীদের অত্যন্ত দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে দেশ পুনর্গঠনে কাজ করতে হবে। যশোরেও সম্প্রতি চেম্বার অব কমার্সের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন অত্যন্ত মেধাবী জাতীয়তাবাদী ব্যবসায়ী নেতা মোঃ মিজানুর রহমান খান।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, অর্জিত বিজয়কে নস্যাৎ করার চক্রান্ত চলছে। স্বৈরাচারের প্রেতাত্মাদের অনেকেই পলাতক, চেম্বার ছেড়ে চলে গেছে। পলাতক অবস্থায় থেকে কোথাও কোথাও তারা তাদের দ্বারা সুবিধাভোগী অনুগতদের দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপন্ন করার জন্য কলকাঠি নাড়ছে। আবার অনেক চেম্বার অকেজো হয়ে রয়েছে।
মিজান বলেন, যেসব চেম্বারে জাতীয়তাবাদী ধারার কিছু নেতৃত্ব রয়ে গেছে, সেখানে তাদের উচিৎ প্রকৃত ব্যবসায়ীদের যারা বিগত আঠারো বছর বৈষম্যের শিকার হয়েছে, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে দেয়া হয়নি, দেশকে এগিয়ে নিতে তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করা। তিনি বিগত ১৮ বছরে স্বৈরাচারের সহযোগীদের যারা ব্যাংক লুট করেছে, অসাধু পন্থায় টাকার পাহাড় গড়েছে, সার্বিকভাবে তাদের দেশবিরোধী অপচেষ্টা প্রতিহত করার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
৯০- এর দশকে ছাত্রদল এবং যুবদল করে আসা ব্যবসায়ী নেতা নেত্রকোনা চেম্বারের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন রশিদ পাঠান রোমেন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে জনবান্ধব করার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানান। তিনি বলেন, অর্জিত বিজয় নস্যাৎ করতে দেয়া হবে না।
রংপুরে চেম্বারগুলোতে এখনো আওয়ামী দৌরাত্ম্য কমেনি। সেখানে জাতীয়তাবাদীরা হালে পানি পাচ্ছে না। ৫ আগস্টের পরিবর্তনকে তারা কোনভাবেই স্বাগততো জানায়ইনি, বরং বিগত ১৬ বছর যারা আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগসহ বিভিন্ন লীগের নামে ব্যবসা-বাণিজ্যে দোর্দন্ড প্রতাপ চালিয়েছে তাদেরকেই পুনর্বাসনের অপচেষ্টা করছে। উইমেন চেম্বারের নেতৃত্বে খানিকটা পরিবর্তন এলেও রংপুর চেম্বার এবং মেট্রোপলিটন চেম্বার এখনো আওয়ামী ঘরানার আশ্রয়-প্রশ্রয়ের বড় ভরসাস্থল।
রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মোঃ রেজাউল ইসলাম মিলন জেলার আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা। বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক। মহানগরীর শালবনে তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক ভবনের একটি ফ্লোরেই মেট্রোপলিটন চেম্বারের অফিস। সঙ্গত কারণেই সেখানে তার কর্তৃত্ব অতুলনীয়। মেট্রো চেম্বারকে শুরু থেকেই তিনি তার একান্ত নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করে আসছিলেন।
৫ আগস্টের পর থেকেই মিলন পলাতক। তার চেম্বারের পরিচালকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ ঘরানার। বিএনপি বা জাতীয়তাবাদী মানসিকতার যে দু-একজন আছেন তারাও মূলত প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে শুরু থেকেই তার অনুগত। কাজেই আত্নগোপনে থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য, চেম্বার পলিটিক্সের সবকিছুই মিলনের আগের মতই নিজের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যে এখনো আওয়ামীদের বিশেষ সুযোগ পাইয়ে দিয়ে তার নিজের লাভবান হওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসায় বসে তিনি তার রংপুরের ব্যবসা স্বাচ্ছন্দের সাথেই পরিচালনা করছেন। সম্প্রতি তিনি ঢাকার বাসায় বসেই রংপুরে বাণিজ্য মেলা ব্যবসায়ের জন্য গোপালগঞ্জের এক আওয়ামী লীগ নেতার সাথে চুক্তি করেছেন বলে জানা গেছে। সামনে ভিন্ন ব্যক্তিকে উপস্থাপন করে নেপথ্যে গত বছরের একই ব্যক্তিকে মেলা ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়ে চেম্বার এর পক্ষ থেকে তার পক্ষে অনুমতির জন্য জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। অবশ্য সেই আবেদনপত্রে সময়ের সুবিধা বিবেচনায় স্বাক্ষর করানো হয়েছে মিলনের নেতৃত্বাধীন চেম্বার পরিচালকদের একদম নীচের সারির একজন বিএনপি সমর্থক ব্যক্তি নুরুল ইসলাম পটুকে দিয়ে।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়