এ যেন রূপকথাকে হার মানায়
লাখ টাকা বেতনের ডিবি হারুন হাজার কোটি টাকার মালিক
- Update Time : ১০:০৯:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ অগাস্ট ২০২৪
- / ৬৬ Time View
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।হারুনের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।
গত মঙ্গলবার দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, পাসপোর্ট, নির্বাচন কমিশনসহ অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠানো হয়েছে। দুদক সূত্রে বিষয়টি জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে হারুন দুর্নীতি করেছেন অভিনব কায়দায়, অকল্পনীয় কৌশলে। যেমন- দেশের টাকা পাচার করতে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন মানি এক্সচেঞ্জ। যার মাধ্যমে নিরাপদে টাকা পাচার করলেও কেউ ধরতে পারেনি। আবার নিজ এলাকা ভাটিতে বেকারত্বের অভিশাপ ঘোচানোর জন্য গড়ে তোলেন প্রেসিডেন্ট পার্ক নামের বিশেষ টুরিস্ট স্পট। বিদেশ থেকে রেমিটেন্স এনে বৈধ আয় দেখানোর জন্য নিউইয়র্ক দুবাই ও জেদ্দায় গড়ে তোলেন সুরম্য অট্টালিকা, হোটেল ও সোনার ব্যবসা। নিজের নামে যৎসামান্য কিছু রেখে সবই করেছেন স্ত্রী, শ্বশুর, ভাই ও বন্ধুর নামে।
মানুষের সম্পত্তি দখলের পর তা বিক্রি এবং সেই টাকা দেশের বাইরে পাঠানোর দায়িত্ব পালন করতেন ডিবির খিলগাঁও জোনের এডিসি সাইফুল। বিদেশে অর্থ পাচারের সুবিধার জন্য গড়ে তোলা হয় নিজস্ব মানি এক্সচেঞ্জ। ঢাকায় এই প্রতিষ্ঠানের অফিস পুরানা পল্টনের আজাদ প্রোডাক্টসের গলিতে। কার্যক্রম পরিচালনায় দুবাইয়ে আছে আরেকটি অফিস। এই মানি এক্সচেঞ্জ পরিচালনা করেন এডিসি সাইফুল ইসলামের দুই ভাই। একজন থাকেন দেশে। আর আরেক ভাই রিফাত অবস্থান করেন দুবাই।
হারুনের অর্জিত অর্থের ফিরিস্তি দেখে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও দুদকের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই দুর্নীতি এতটাই সূক্ষ্ম কায়দায় করা হয়েছে যে তদন্তেও এর কোনো মাথাম্ন্ডু পাওয়া যাবে না। মামলা দায়ের করা হলেও মেরিটের অভাবে সেটার চার্জশিট দেওয়াও কঠিন হবে। দেশের সম্পদের না হয় একটা কূল-কিনারা করা যাবে- কিন্তু বিদেশে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা কিংবা লগ্নিকে আইনের আওতায় আনা খুবই কঠিন হয়ে যাবে।
গায়ের জোরে ওপর মহলের নির্দেশে মামলা করে গোঁজামিলের চার্জশিট দিলেও আদালতে সেগুলো টিকবে না- যদি না আদালতেও হস্তক্ষেপ করা হয়। কাজেই এগুলো এখন মানুষের মুখরোচক খবর হয়েই থাকবে। আর কৌতূহল ও বিস্ময়ের সৃষ্টি করবে কিভাবে গ্রামের একজন কৃষকের ভুয়া, মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরি নিয়ে রাতারাতি উঠে গেছে অর্থের পাহাড়ে।
অথচ তার গ্রামে গিয়ে মানুষের মুখে শোনা যায়, নানা রকম চকমপ্রদ কাহিনী। ঢাকার অদূরে ভাটি এলাকা কিশোরগঞ্জের মিঠামইন থানার হোসেনপুর গ্রামের এক গরিব চাষি আবুল হাশেমের ছেলে হারুন অর রশীদ। দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থায় কিশোরগঞ্জ শহর থেকে তাদের গ্রামে যেতে হলে নৌকায় লাগত কয়েক ঘণ্টা। এখন যোগাযোগের বিস্ময়কর উন্নতির দরুন সেখানে মাত্র এক ঘণ্টায় যাওয়া সম্ভব। এমন অনুন্নত ভাটি এলাকার ছেলে হারুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আশপাশের মানুষের সহযোগিতা নিতেন।
তার এক সহপাঠী জানান, একাত্তরের যুদ্ধের সময় তার বাপ দাদা ও চাচাদের ভূমিকা ছিল খুবই জঘন্য। সে সময় তার বাবা আবুল হাশেম, চাচা সোলেমান এবং কুরবান আলী, বাদশা মোল্লার নেতৃত্বে পাকিস্তানি মিলিটারিদের সহযোগিতা করতেন। তাদের নেতৃত্বে মিঠামইন থানার জনৈক শাহেদ সাহেবের বাড়িতে পাকিস্তানি মিলিটারিসহ আক্রমণ করে ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়।
তবে ১৯৯৩-৯৪ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। তখন অর্থের অভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৯৯৯-২০০০ সালের দিকে সালসাবিল বাসের টিকিট চেকারের চাকরি নিয়েছিলেন। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে হারুন তার বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বানিয়েছিলেন। সেটি ব্যবহার করেই বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশের চাকরি পান। সারদায় ট্রেনিংয়ের সময় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে চাকরিচ্যুত হন। এরপর মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরি করেন।
পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ছাত্রলীগ করার কারণে হারুন পুলিশের চাকরি ফিরে পান। তারপর আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। রাতারাতি বিস্ময়কর উত্থান ঘটতে থাকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লালবাগ এলাকার ডিসি থাকাবস্থায় বিএনপি নেতা জয়নাল আবেদীন ফারুককে রাজপথে লাঞ্ছিত করে রাতারাতি আলোচনার শীর্ষে চলে আসেন। তারপর গোটা পুলিশের আলোচিত চরিত্রে পরিণত হন।
গত পনেরো বছরে একের পর এক পদোন্নতি পেয়েছেন হারুন। বিশেষত তার এলাকার নেতা রাষ্ট্রপতি হবার পর থেকে আরও বিশেষ নেক নজরে ছিলেন পুলিশের শীর্ষ মহলের। এ ধারায় সর্বশেষ তিনি পেয়ে যান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান। যা পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার। এ পদে তার সর্বসাকুল্য বেতন-ভাতাদি মিলে লাখ টাকার মতো পেতেন। অথচ এই টাকার একজন পুলিশ কর্মকর্তা এখন দেশের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে গেলেন। কিন্তু কিভাবে?
এটাই মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। মোটা দাগে যার উত্তর হচ্ছে- তিনি চাকরিতে থাকাবস্থায় কোনোকিছ্রুই তোয়াক্কা করেননি। ধরাকে সরাজ্ঞান করাই ছিল তার অবৈধ আয়ের প্রধান উৎস। যখন যেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই নানান অনিয়মে জড়িয়েছেন। প্রতিটি ধাপে প্রতারণা ও উচ্ছৃঙ্খল কর্মকান্ডে জড়ালেও তাকে কখনো শাস্তি পেতে হয়নি। বরং পদায়ন করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব ইউনিটে।
ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, জিম্মি করে অর্থ আদায়, মারধর, জমি দখল, বাড়ি দখল, প্লট দখল, ফ্ল্যাট দখল, গুম, খুন, হত্যা, অর্থ পাচার, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, আটকে রেখে নির্যাতন, নিয়োগ বাণিজ্য, নারী কেলেঙ্কারিসহ হেন কোনো অপরাধ নেই, যার সঙ্গে জড়াননি হারুন। তবুও বছর বছর পেয়েছেন পদোন্নতি। এসব অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। রাজধানীর উত্তরা, গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জ ঘুরে ডিবি হারুনের অন্তত হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এত অনিয়ম অপরাধ করেও হারুন বরাবরই থেকে গেছেন ধরা- ছোঁয়ার বাইরে। কেউ তার বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করতে পারেননি। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর হারুন রশীদও লাপাত্তা হয়ে যান। এ সুযোগে মানুষজন তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে। তিনি ডিবিতে থাকাবস্থায় কীভাবে নিরীহ বিত্তবান ব্যবসায়ীদের ধরে সামারি করতেন, নির্যাতন, ভয়-ভীতি দেখিয়ে, জেলে পুরে। তেমনই একজন ভিকটিম হলেন রাজধানীর ইসিবি চত্বরের নাজিম উদ্দিন। গত বছরের ৩১ অক্টোবর কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই তাকে তুলে নিয়ে ডিবিতে আটক করে চরম অমানুষিক নির্যাতন চালান হারুন।
কেন তাকে ডিবি তুলে নিয়ে গিয়েছিল জানতে চাইলে নাজিম উদ্দিন ভুঁইয়া অভিযোগ করেন, তার কেনা এক বিঘা জমি ইসিবি চত্বরের ভূমিদস্যু খান আখতারুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরেই দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কোনোভাবেই না পেরে শেষ পর্যন্ত ডিবির হারুনকে দিয়ে এ কাজ করান। ডিবিতে আটকের পর পরই হারুনের সামনেই পেটাতে থাকে অন্যরা। এ সময় তাকে বাঁচতে হলে ওই এক বিঘা জমি খান আখতারুজ্জামানকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেন হারুন।
এ সম্পর্কে নাজিম বলেন-এমনভাবে হারুন আমাকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেছে, ৬টি মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে, যেন তার সঙ্গে আমার পারিবারিক ঝগড়া ছিল অনেকদিনের। তার কথায় রাজী হয়ে শেষ পর্যন্ত ১৭ লাখ টাকা নগদ দিয়ে নির্যাতন থেকে রেহাই পাই। কিন্তু জেল খাটতে হয় তিন মাস।
হারুনের সঙ্গে আখতারুজ্জামানের সখ্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে নাজিম বলেন, সেটাও ভূমিদস্যুতা নিয়ে। মাটিকাটা এলাকার এক সময়ের লজিং মাস্টার শুধু ভূমিদস্যুতা করে এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। র্যাব ডিবি থানা পুলিশকে টাকা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে ভূমি দখল করত। এমন শত শত ভিকটিম আজ ভিটাহারা। তারা এখন সবাই মুখ খুলতে শুরু করেছে। হারুন সস্ত্রীক গত বছর ভূমিদস্যু আখতারের একটি মার্কেট উদ্বোধনের পরপরই আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জানতে পেরেছি আখতারের সঙ্গে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব ছিল হারুনের। আমার মতো আরও অনেককেই হারুনের মাধ্যমে ঘায়েল করেছে আখতার। আমরা এসব অপকর্মের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে শাস্তি চাই।
এদিকে দুদকের তদন্তেও হারুনের বিরুদ্ধে অবৈধ আয়ের ব্যাপক তথ্য-প্রমাণাদি পেয়েছে বলে জানা গেছে। দুদক প্রাথমিক তদন্তের শুরুতে নিশ্চিত হয়েছে- তার নিজ এলাকায় মিঠামইনে তৈরি করা প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট সম্পর্কে। বর্তমানে হারুনের ভাই ডাক্তার শাহরিয়ার মিঠামইনে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। এ ছাড়াও গাজীপুরে রয়েছে সবুজ পাতা রিসোর্ট এবং ‘গ্রিন টেক’ নামে আরও একটি বিলাসবহুল রিসোর্টের শেয়ার। নন্দন পার্কেও শেয়ার আছে। আছে আমেরিকান ডেইরি নামে একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ। এই কোম্পানির এমডি হারুনের স্ত্রী। ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাবেক এমপি আনিসের সঙ্গে ফিশারিজ এবং রেস্টুরেন্টের যৌথ ব্যবসা আছে তার। গাজীপুরের পুলিশ সুপার থাকার সময় ওই এলাকার ভূমিদস্যু কামরুজ্জামান ওরফে কামরুল ওরফে মাউচ্ছা কামরুলের সঙ্গে সখ্য ছিল তার। কামরুলের ভূমিদস্যুতার রক্ষক ছিলেন এই পুলিশ সুপার। সম্প্রতি কামরুলের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে ডিআইজি হারুনের উপস্থিতির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
তার সম্পর্কে গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে- হারুন যখন যেখানে চাকরি করেছেন, সেখানেই জড়িয়েছেন নানা অপকর্মে। গাজীপুরের এসপি থাকাকালে ২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর গভীর রাতে ঢাকাণ্ডময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্ন এমসি বাজারের পাশে তাহের অ্যান্ড সন্স ফিলিং স্টেশনের ৭ কোটি টাকার ১ বিঘা জমি একটি গ্রুপকে দখল করে দেন হারুন। এ ছাড়া গাজীপুরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা রাকিব সরকারকে সাড়ে ১৭ শতক জমি দখল নিতে পুলিশি সহায়তা দেন হারুন। ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর গাজীপুর মহানগরের মাধবপুর এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা কফিল উদ্দিনের দুই বিঘা জমি একই কায়দায় দখলে নেওয়া হয়। গাজীপুরের ১০০ কোটি টাকা মূল্যের একখন্ড জমি আমমোক্তারনামা জোর করে রেজিস্ট্রি করে দিতে সহযোগিতা করার অভিযোগে হারুনসহ আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়।
গাজীপুরের দায়িত্বে থাকাকালে হারুনের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে তিন শতাধিক মানুষকে হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় সবার কাছ থেকেই তিনি ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। যারা টাকা দেননি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন। গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে বদলি করা হলে সেখানে নানা অপকর্মে জড়ান হারুন। ওই সময় ১৪ লাখ করে টাকা নিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে ১৮ জন পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের প্রমাণ পায় পুলিশ সদর দপ্তর। পরে ওই কনস্টেবলরা চাকরি হারালেও হারুনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ওই সময় বেশ কয়েকজন শিল্পপতিকে তুলে নিয়ে সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ ছিল হারুনের বিরুদ্ধে। দাবি অনুযায়ী চাঁদা না পেয়ে পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমের ছেলে, আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজের স্ত্রী-পুত্রকে তুলে নিয়ে যান হারুন। ওই ঘটনায় তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের কাছে অভিযোগ করেন গাজীপুরের অনেক মানুষ। তিনি কোনো প্রতিকার করতে পারেননি। পরে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন।
হারুনের আরেক ভাই মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান (জিয়া) পুলিশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে এএসআই পদে চাকরি করছেন। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন মদের বার থেকে কয়েক কোটি টাকা মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গত বছর উত্তরার কিংফিশার বারে অভিযান চালিয়ে মালিক মোক্তারকে গ্রেপ্তার করে। তার কাছ থেকেও তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষে মোক্তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সহায়তায় রেহাই পান।
জানা গেছে, রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় সম্পত্তি দখল ও দেখাশোনার জন্য আছে তিন সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি। নামে-বেনামে অন্তত তিনটি রিসোর্টের মালিকানা আছে তার। রয়েছে একাধিক আবাসিক হোটেল। অন্তত ১০টি কোম্পানির মালিক তিনি। শুধু ঢাকায়ই আলিশান বাড়ি করেছেন দুই ডজনেরও বেশি। এর বাইরে আছে অগণিত প্লট ও ফ্ল্যাট।
জানা গেছে, তার এক পাতানো মামা হলেন জাহাঙ্গীর আলম। হারুনের সব ব্যবসা জমি-জমা ও সম্পদের দেখভাল করেন জাহাঙ্গীর। হারুন নিজের মানি এক্সচেঞ্জারের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করে গড়ে তোলেন বাড়ি গাড়ি ও ব্যবসা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বিলাসী জীবনযাপন করছে হারুনের পরিবার। এ ছাড়া বিশ্বের অন্তত ছয়টি দেশে রয়েছে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সৌদি আরবের জেদ্দায় কথিত মামা জাহাঙ্গীরের এক বন্ধুর মাধ্যমে একটি আবাসিক হোটেলে বিনিয়োগ করেছেন। দুবাইয়ে একটি পাঁচ তারকা হোটেল, এডিসি সাইফুলের ভাই রিফাতের সঙ্গে স্বর্ণ ব্যবসাসহ নামে-বেনামে রয়েছে অসংখ্য সম্পদ।
হারুনের স্ত্রী ২০০৭ সালের দিকে ডিবি ভিসায় আমেরিকায় পাড়ি জমান। এর কিছুদিন পর হারুনও সেখানে যান। সেখানকার নাগরিকত্বও রয়েছে তার। তিনি বাংলাদেশের সরকারি পাসপোর্ট ব্যবহার না করে সাধারণ পাসপোর্ট ব্যবহার করেই বিদেশে ভ্রমণ করেন। পাচারের টাকাতেই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে রয়েছে নিউ হাইড পার্ক এলাকায় স্ত্রীর নামে পাঁচ মিলিয়ন ডলারের একটি বাড়ি ও একটি ১০তলা মার্কেট। এটি হারুনের শ্বশুরের নামে করা হয়েছে।
এদিকে রাজধানীর উত্তরাতেই দুদক খোঁজ পেয়েছে হারুনের শতাধিক ফ্ল্যাট ও প্লটের। উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের ২১ নম্বরে ৬ তলা একটি বাড়ি। এই বাড়িটি বন্ধক রেখে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। ১৩ নম্বর সেক্টরের শাহ মখদুম এভিনিউয়ে ১২ নম্বর প্লটেরও মালিক। এখানে তাজ ফুডকোর্টসহ কয়েকটি দোকান ভাড়া দেওয়া আছে। একই সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের ৭৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের একটি প্লট জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তির কাছে ভাড়া দেওয়া আছে।
এ ছাড়া ৩ নম্বর সেক্টরে ১৫ নম্বর রোডের ২৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন, ১৩ নম্বর সেক্টরে ৩ নম্বর রোডের ৪৯ নম্বর বাড়িতে ৬ তলা ভবন, ৩ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ১ নম্বর হোল্ডিংয়ে ৭ কাঠার বাণিজ্যিক প্লট, ১০ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের ৩৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে ৫ কাঠার একটি প্লট এবং ৫ নম্বর সেক্টরে ৬ নম্বর রোডে ঢুকতেই প্রথমে ২৯ ও ৩০ নম্বর হোল্ডিংয়ের ১০ কাঠার দুটি প্লটের মালিক তিনি।
একটিতে টিনশেড ঘর বানিয়ে ভাড়া দেওয়া এবং অন্যটি গোডাউন। ১৪ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডের ১৭ ও ১৯ নম্বর প্লট চারটি কোম্পানির শোরুম হিসেবে ভাড়া দেওয়া। ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৪ নম্বর বাড়ির ৫ তলায় কথিত মামা জাহাঙ্গীরের অফিস। উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর প্লটটি হিরন নামের এক ব্যক্তির কাছে ৩২ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন হারুন। ৩ নম্বর সেক্টরের সাবেক ৯ নম্বর রোড বর্তমানে রবীন্দ্র সরণিতে ৭ কাঠার ৪১ নম্বর প্লটটি মাসিক ১৪ লাখ টাকায় ভাড়া দেওয়া আছে।
১১ নম্বর সেক্টরের উত্তরা স্মৃতি কেবল টিভি লিমিটেডের পাশে ৫ কাঠার আরেকটি প্লট ‘স্টার কার সিলেকশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া আছে। এ ছাড়া ১৩ নম্বর সেক্টর জমজম টাওয়ারের পাশে, উত্তরা থার্ড ফেইসে, পূর্বাচলে কয়েক ডজন ফ্ল্যাট রয়েছে হারুন পরিবারের। আরও আছে বনানী কবরস্থানের দক্ষিণপাশে। এখানে ২০ কাঠার প্লট দখল করে একটি কোম্পানির কাছে ৭০ কোটি টাকায় বিক্রি করেন হারুন। টঙ্গীর সাতাইশ মৌজায় ৮ বিঘা জমিতে কোনো অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে ‘জেএইচ-জিওটেক্স লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। টঙ্গীর গুশুলিয়া মৌজায় ছায়াকুঞ্জ-৫ আবাসিক প্রকল্পের ভেতরে ১২ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসিক হোটেল।
হারুনের জুলুম নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি প্রবাসীরাও। ডিজে সানি নামে থাইল্যান্ড প্রবাসী এক ব্যক্তির অভিযোগ- তাকে ডিবি অফিসে ডেকে নিয়ে হারুন ২০ লাখ টাকা চান। পরে মামলার ভয়ে ১০ লাখ টাকা দেন তিনি। সানি বলেন, তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়েও তার বিরুদ্ধে এক নারীকে দিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। সেই মামলায় ২১ দিন জেল খেটে ছাড়া পেয়েছেন। কিন্তু এর প্রতিবাদও করতে পারেননি।
গাজীপুরে অভিযোগে পাহাড়
বহুল আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ। সরকার পতনের পর তার থেকে এই প্রভাবশালী কর্মকর্তার হদিস নেই। হারুনের নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে ভুক্তভোগীসহ অনেকে। টানা চার বছর গাজীপুর জেলায় এসপি থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। টাকার জন্য এমন কিছু নেই যা তিনি করেননি। সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও বোকা বানিয়েছেন। তার অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি সাংবাদিকরাও।
যারা তুলে নিয়ে যাচ্ছিলো তাদের তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন তাকে নেওয়া হচ্ছে। ডিবির সদস্যরা জবাব দেন এসপি হারুনের নির্দেশে তাকে নেওয়া হচ্ছে।
দৈনিক মুক্ত সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রায়হান বলেন, ‘‘২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর দুপুরে বাসা থেকে বাবার জন্য অফিসে খাবার নিয়ে আসি। অফিসে আসার পর জানতে পারি, বাবাকে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়েছে। আমার বাবা একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। তিনি একটি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। তাকে যেভাবে নিজ কার্যালয় থেকে ডিবি পুলিশ দিয়ে জোরপূর্বক উঠিয়ে নেওয়া হলো, তা অকল্পনীয়।
‘কেনো, কী কারণে পুলিশ নিয়ে গেলো তা আমরা জানতে পারলাম না। বিকেলে শুনি একটা মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আমার বাবার অপরাধ ছিল একজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তথ্যবহুল অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তার নিজ পত্রিকায় প্রকাশ করা। এই অপরাধে তাকে কোনো মামলা ছাড়াই কেনো উঠিয়ে নিয়ে গেলো, এর বিচার হওয়া উচিত। শুধু তাই নয়, ১৭ দিন জেল খাটার পর ২১ নভেম্বর জামিন হয়। সেদিন কারাগারের ভিতর থেকে আবারও ডিবি পুলিশ দিয়ে উঠানো হয়। এ সব কিছুই বর্তমান সাবেক ডিবি প্রধান ও গাজীপুরের এসপি হারুনের নির্দেশে হয়েছিল।”
অপর একজন সাংবাদিক মো. আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। তিন দশক ধরে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৯ সালের ২ মে সন্ধ্যা সাড়ে আটটা। ‘বাংলাভূমি’ অফিসে বসে কাজ করছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। হঠাৎই প্রতিবেদন তৈরির জন্য তথ্য দিবে বলে এক ব্যক্তি তাকে ফোন করেন। এরপর দেখা করতে গেলে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান ফটকের সামনে থেকে এসপি হারুনের নির্দেশে সাদা পোশাকে থাকা কয়েকজন ব্যক্তি হায়েস গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ২০ দিন পর পরিবার তার সন্ধান পায়।
পরে পরিবার জানতে পারে সাংবাদিক লতিফকে ৫০০ পিস ইয়াবা দিয়ে চালান করা হয়েছে। লতিফ সিদ্দিকী প্রায় ৯ মাস জেল খেটেছেন। এরপর রিমান্ডে নিয়ে এবং জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও তিনটি মামলায় তাকে আসামি করা হয়। মামলা চালাতে গিয়ে লতিফ সিদ্দিকী এখন নিঃস্ব। এমনকি অর্থ সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে তার সন্তানদের লেখাপড়াও।
‘মুক্ত বলাকা’ নামে পত্রিকায় ২০১৭ সালে একটি নিউজ হয়। নিউজটি হারুনের বিপক্ষে যাওয়ার পরেরদিন রাতে ২০০ পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করা হয় ওই পত্রিকার সম্পাদক আলমগীর হোসেনের বাড়ি। সেদিন তিনি বাড়িতে ছিলেন না। পরে তার বাড়িতে ব্যাপক তল্লাশি চালানো ও ভাঙচুর করা হয়। এরপর তিনি ৩ মাস আর গাজীপুরে ফিরতে পারেননি।
‘মুক্ত বলাকা’র সম্পাদক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘একটি নিউজ প্রকাশ করেছিলাম যে নিউজটা তৎকালীন এসপি হারুনের পছন্দ হয়নি। নিউজ প্রকাশের পরেরদিন শুক্রবার রাতে আমাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও তুলে নেওয়ার জন্য ২০০ পুলিশ নিয়ে আমার বাড়ি ঘেরাও করেন। ওইদিন আমি পারিবারিক কাজে বাগেরহাট গিয়েছিলাম বলে আমাকে পায়নি। তবে বাড়িতে ভাঙচুর করে এবং আমাকে গাজীপুর আসতে মানা করে। পরে হারুনের কারণে তিন মাস আমি পালিয়ে বেড়াই।’
শুধু সাংবাদিক নয়, বিরোধীদলীয় নেতা, সরকার দলীয় নেতা, ব্যবসায়ী ও ধনীর সন্তানরা ছিল হারুনের টার্গেট। মূলত হারুন গাজীপুরের এসপি থাকাকালীন তার সমস্ত অপকর্ম করতেন ডিবি দিয়ে। সেসময় তিনি ডিবির ১৩-১৪টি দল গঠন করেছিলেন। সেময় ডিবি গাজীপুরের আতঙ্কের নাম ছিল। থানাগুলো ছিল নামে মাত্র। সব কার্যক্রম চালাতো হারুনের ডিবি টিম।
স্থানীয় ও ভুক্তভোগীরা বলছেন, এসপি হারুনের নির্দেশে প্রতি রাতে ডিবির একাধিক দল নেমে পড়তো টার্গেট-কৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে। গাড়িতে মজুত রাখা হতো ইয়াবা, অস্ত্র ও বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। সুযোগ বুঝে ওইসব জিনিস দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হতো নিরপরাধ ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও ধনী পরিবারের সন্তানদের। দিনে হারুনের নেতৃত্বে পরিকল্পনা হতো, রাতে হতো অধিকাংশ অভিযান।
গাজীপুরে এসপি হারুনের চার বছরের রাজত্বে মাদক, আবাসিক হোটেলে দেহ ব্যবসা ও জুয়ার জমজমাট ব্যবসা চলে। আর এসব অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিনি হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। হারুন আসার আগে গাজীপুরের কোথাও হোটেলে দেহ ব্যবসা ছিল না। তার আমলে গড়ে ওঠে কয়েকশ’ আবাসিক দেহ ব্যবসার আস্তানা। এসব আস্তানা ও জুয়ার আসর থেকে ক্যাশিয়ার হিসেবে টাকা তুলতেন তৎকালীন ডিবি ও সদর থানা পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা। যাদের অনেকেই এখনো গাজীপুরে রয়েছেন।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নেপথ্যেও হারুনের ইন্ধন ছিল। জেলার শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা করা হয়েছে। মামলা আর হামলার ভয়ে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা ঘরছাড়া হয়েছেন। মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নানকে দুটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের পৃথক অভিযোগে মিথ্যা মামলা দিয়ে বরখাস্ত করার পেছনে তার অবদান রয়েছেন।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, চান্দনা এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরে যাওয়ার কথা প্রথমে পুলিশ স্বীকার করে। কিন্তু পরে নাশকতামূলক অগ্নিকান্ড দেখিয়ে মামলা দেওয়া হয়। অথচ আগুন লাগার অন্তত পাঁচ ঘণ্টা আগে মান্নানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তখন হারুন এতটাই বেপরোয়া হয় উঠেছিলেন যে, টাকা ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। টাকা না দিলে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদেরও হেনস্থা করতেন।
কালিয়াকৈরের যুবলীগ নেতা রফিক হত্যার পর ডিবির উৎপাতে কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা, পল্লীবিদ্যুৎ, হরিণহাটিসহ আশপাশের এলাকা প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। শতাধিক লোককে ডিবি আটক করে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। এক ব্যক্তিকে দুই থেকে তিনবার আটক করার ঘটনাও ঘটেছে। ওই সময়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী মুচি জসিমকে দিয়ে কাজ করতেন হারুন। পরবর্তীতে হারুন গাজীপুরের এসপি পদ ছাড়লে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় মুচি জসিম।
সফিপুর বাজার ব্যবসায়ী মোতালেব বলেন, ‘হারুন ডিবি দিয়ে তুলে নিয়ে চার দিন নির্যাতন করে। আমার হাতের পাঁচটি নখ তুলে ফেলে। পরে এক কোটি টাকা দিলে মুক্তি দেওয়া হবে বলে জানায়। আমার এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তবুও নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ছয় লাখ টাকা নগদ ও ছয় লাখ টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করি। আমাদের বাজারের রট সিমেন্টের ব্যবসায়ী আজিজ সাহেবকে ডিবি দিয়ে তুলে নিয়ে অর্ধকোটি টাকা আদায় করে হারুন।’
মাধবপুর এলাকার ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়া স্বত্বেও হারুন আমাদের হয়রানি করেছে। তবে আমি ভয় পাইনি, কোনো টাকা পয়সাও দেইনি। জমিজমার বিষয়ে হারুনের হস্তক্ষেপ তোয়াক্কা না করে প্রতিবাদ করেছি।’