বলিভিয়ায় ২০ বছরের বামপন্থি শাসনের অবসান, নতুন প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো পাজ

- Update Time : ০১:৩৬:৪৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫
- / ১৫৯ Time View
রক্ষণশীল হোর্হে ‘টুতো’ কিরোগাকে হারিয়ে বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রান অফে বিজয়ী হয়েছেন মধ্যপন্থি রদ্রিগো পাজ।
তার জয় দেশটিতে প্রায় দুই দশকের বামপন্থি শাসনের অবসান ঘটাল, দেশটিতে এক প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট এই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির সেনেটর পাজ রান অফে ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন বলে বলিভিয়ার নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের প্রাথমিক ফলের বরাত দিয়ে বলছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
প্রেসিডেন্ট হলেও পার্লামেন্টে পাজের দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় ভালোভাবে দেশ শাসনে তাকে অন্যদের সঙ্গে জোট গঠন করতে হবে।
আগামী ৮ নভেম্বর নতুন প্রেসিডেন্ট লাতিনের দেশটির দায়িত্বভার নেবেন।
“আমাদের অবশ্যই বিশ্বের কাছে বলিভিয়াকে খুলে দিতে হবে,” কিরোগা হার মেনে নেওয়ার পর লা পাজ থেকে দেওয়া বিজয়ের ঘোষণায় এমনটাই বলেছেন পাজ।
৫৮ বছর বয়সী এ সেনেটরের জয়ের মাধ্যমে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে এক ঐতিহাসিক মোড বদল ঘটল। ২০০৬ সাল থেকে বলিভিয়া মূলত টানা বলিভিয়াস মুভমেন্ট ফর সোশালিজম বা মাসের শাসনে ছিল, যারা এককালে সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসীদের কাছ থেকে একচেটিয়া সমর্থন পেত।
পাজ বলিভিয়ার চলমান সামাজিক কর্মসূচিগুলো চালু রাখার পাশাপাশি বেসরকারি খাত নেতৃত্বাধীন উন্নয়নকে উৎসাহিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসের প্রতিষ্ঠিত মাসের অনেক ভোটারকেই আকৃষ্ট করেছে। এ ভোটারদের অনেকে আবার রক্ষণশীল কিরোগার প্রস্তাবিত কৃচ্ছ্রতাসাধন কর্মসূচি নিয়ে আতঙ্কিত ছিলেন। এসবই রান-অফে পাজের জয়ে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে হচ্ছে।
তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে অগাস্টে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফার ভোটে মাসের প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছিল।
“এই নির্বাচনকে বলিভিয়ার রাজনীতিতে সন্ধিক্ষণ বলা যায়। বলিভিয়া এখন এক নতুন দিকে যাচ্ছে,” বলেছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সাউদার্ন আন্দিজের বিশ্লেষক গ্লায়েলডিজ গনজালেজ কালানচে।
রানঅফের আগে পাজ ও কিরোগা উভয়েই নির্বাচনে জয়ী হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো করা ও বলিভিয়ার ভঙ্গুর অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত আর্থিক সহায়তা চাওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
সেপ্টেম্বরের শেষদিকে পাজ জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেড়শ কোটি ডলারের একটি অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রস্তাব হাজির করেছিলেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও কয়েকদিন আগে বলেছেন, কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী নেতৃত্বের পর বলিভিয়ার দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীই ওয়াশিংটনের সঙ্গে ‘মজবুত, ভালো সম্পর্ক গড়তে চাইছে’।
“রূপান্তরের সুযোগ এই নির্বাচন,” বুধবার এমনটাই বলেছিলেন তিনি।
রোববার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোটের দিন লা পাজের এক ভোটকেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন লোরদেজ মেনদোজা। তিনি বলছিলেন, বামপন্থি মাসের শাসনকার দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়ার কথা।
“আমরা সন্তানরা জন্ম নিয়েছে ও বেড়ে উঠতে একটা সরকারই দেখেছে। আশা করছি তারা এবার অন্যান্য সম্ভাবনা ও বিকল্পগুলোও দেখতে পারবে,” বলেছেন এ নারী।
রানঅফের আগে ভোটারদের মধ্যে মূল আলোচনাই ছিল বলিভিয়ার ভঙ্গুর অর্থনীতি। একসময় যে দেশ ব্যাপক পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করতো, তা অনেকটাই কমে এসেছে, মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, জ্বালানি সঙ্কটও দেখা দিয়েছে।
দুই প্রার্থীই মাস আমলের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক মডেল বদলে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পাজ চাইছেন ধীরে ধীরে সংস্কার করতে। তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর প্রণোদনা দিতে চান, অঞ্চলগুলোকে দিতে চান অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন। কিরোগার প্রস্তাব ছিল ব্যাপক কৃচ্ছ্রতাসাধন ও আইএমএফ থেকে সহায়তা নেওয়া।
“২১ শতকে বলিভিয়ার গণতন্ত্রের নতুন পর্বে ঢুকতে যাচ্ছি আমরা। আমরা মানুষের জন্য একটি অর্থনীতি গড়ার চেষ্টা করতে যাচ্ছি, যেখানে আগের মতো রাষ্ট্র আর কেন্দ্রীয় অক্ষে থাকবে না,” রানঅফের দুইদিন আগে রয়টার্সকে বলেছিলেন পাজ।
অনেক ভোটার অবশ্য পাজের এমন অবস্থানে খুশি নন।
“আমার মনে হয় তিনি বিদায়ী সরকারের পাপেট,” বলেছেন লা পাজের একটি নখ পরিচর্যা কেন্দ্রে কাজ করা ২১ বছর বয়সী এস্থার মিরান্ডা।
রানিংমেট এডমুন্ড লারার কারণেও পাজ অনেক ভোটারকে আকৃষ্ট করতে পেরেছেন বলে অনেকের ভাষ্য। সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা লারা দুর্নীতি উন্মোচনে করা টিকটক ভিডিওর জন্য বেশ সুপরিচিত। তার পপুলিস্ট আবেদন পাজকে তরুণ ও শ্রমজীবী ভোটারদের সঙ্গে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
তবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই পাজকে তাৎক্ষণিক কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হবে। এর মধ্যে আছে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা ও নানাভাগে বিভক্ত পার্লামেন্টে জোট গড়া।
বিদায়ী হাইড্রোকার্বনমন্ত্রী আলেহান্দ্রো গালারডো কয়েকদিন আগে বলেছিলেন, জ্বালানি আমদানির জন্য বিদেশি মুদ্রা পেতে রাষ্ট্রীয় জ্বালানি কোম্পানিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
পাজ বলেছেন, তিনি এ সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন এবং তার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েকদিনেই মধ্যে দেশে ডিজেল ও গ্যাসোলিন পৌঁছানোর ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।
মধ্যপন্থি এ রাজনীতিক সার্বজনীয় জ্বালানি ভর্তুকি ধাপে ধাপে তুলে দেওয়ারও পক্ষে। ঝুঁকিতে থাকা গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দেওয়া অব্যাহত থাকবে, তবে কৃষি ব্যবসাসহ বড় বড় খাতকে বাজারমূল্যে জ্বালানি কিনতে হবে, এমনই তার ভাবনা।
এদিকে বলিভিয়ার প্রধান শ্রমিক ইউনিয়ন সেন্ট্রাল অবরেরা বলিভিয়ানা (সিওবি) এর আগে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিল, মাস সরকারের আমলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে যেসব অর্জন হয়েছে, তার বিরুদ্ধে যে কোনো হুমকি তারা প্রতিহত করবে। এর মানে হচ্ছে, রাস্তায় আন্দোলন এড়াতে পাজ সরকারকে নানান কৌশলও নিতে হবে।
এদিকে পার্লামেন্টের সমর্থনও পাজের জন্য খুবই জরুরি। কিন্তু তার দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিসি) নিম্নকক্ষের ১৩০ আসনের মধ্যে জিতেছে মাত্র ৪৯টি, উচ্চকক্ষ সেনেটেও ৩৬টি আসনের মধ্যে পেয়েছে ১৬টি। কিরোগার রক্ষণশীল জোট খানিকটা পিছিয়ে আছে। তারা নিম্নকক্ষে জিতেছে ৪৩ আসন, সেনেটে ১২টি।