নিজেদের টাকায় তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করব: কবির বিন আনোয়ার
- Update Time : ০২:৫০:৩৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ মে ২০২৩
- / ১১৩ Time View
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেছেন, বৈশ্বিক মন্দার কারণে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে গেলেও আমরা চুপ করে বসে থাকব না। পদ্মা সেতুর মতো নিজেদের টাকায় এর বাস্তবায়ন করব।
বুধবার (২৪ মে ) রংপুর সার্কিট হাউস এক সাক্ষাৎকারে কবির বিন আনোয়ার এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন,আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে উত্তরবঙ্গের মানুষ এর সুফল পেতে শুরু করবে। তবে মহামারি করোনা ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এ মুহূর্তে একসঙ্গে আট হাজার কোটি টাকা দেয়া সম্ভব হবে না তবে পর্যায়ক্রমে এর বাস্তবায়ন করা হবে।
কবির বিন আনোয়ার বলেন, ভারতের সঙ্গে যে ৫৪টি অভিন্ন নদী আছে তার ৩৬টিই উত্তরাঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তিস্তা ছাড়াও দুধকুমার ও ধরলা নদীদুটি ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় পড়েছে। অভিন্ন তিস্তাসহ আরও ৮টি নদীর পানি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে।
২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর মধ্যে একটা ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট হয়েছিল। যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের অনৈক্যের কারণে চুক্তিটি আলোর মুখ দেখেনি, তবুও বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা থেমে নেই।
আন্তর্জাতিক নদী ও পরিবেশগত যে আইনকানুন ও নিয়ম বিশ্বে স্বীকৃত আছে, তাতে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ঠিক রাখাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, নদীকে বাঁচিয়ে রেখে তারপর পানি ভাগাভাগি।
তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক কৌশল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে। ভারতের কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু রাজ্যের মধ্যে কৃষ্ণা ও কাবেরি নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ভাটির অংশের মানুষ ও প্রাণিজগৎকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজনে উজানে ইরিগেশন বন্ধ করে কৃষকদের পেশা পরিবর্তনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তবু ভাটির অংশকে বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষার নির্দেশ দিয়েছিলেন সে দেশের আদালত।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যুক্তি ও ভিত্তির ওপর অনড় থেকেই আলোচনা অব্যাহত আছে। যে পরিমাণে পানি ভাগাভাগি হোক না কেন, বাংলাদেশই লাভবান হবে। কারণ, ভাগাভাগির পরও নদীর অবশিষ্ট পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়বে।
পানিবণ্টন চুক্তি বা পর্যাপ্ত পানি না পাওয়া পর্যন্ত তিস্তা মহাপরিকল্পনা কতটা কার্যকর হবে,এমন প্রশ্নের জবাবে কবির বিন আনোয়ার বলেন, একটি হিসাব উল্লেখ করে বললে সবার বুঝতে সুবিধা হবে। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রবহমান পানির মাত্র ৮ শতাংশই আমরা ব্যবহার করতে পারি। বাকি পানি কিন্তু সাগরে পতিত হয়। এ ছাড়া তিস্তা মহাপরিকল্পনার মৌলিক বিষয়টি হবে বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রেখে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনানুসারে তা ব্যবহার করা।
তিস্তা ব্যারেজের উজানে ১২ কিলোমিটার অংশে বড় রিজার্ভার ও আরও বড় একটি ব্যারেজ নির্মাণ, তিস্তার আশপাশ দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদী, পুকুর-বিলসহ সমস্ত জলাধারকে সংযুক্ত করে সেসবে পানি ধরে রাখতে নানা কর্মকাণ্ড ও অবকাঠামো নির্মিত হবে। এবং তিস্তা নদীর মূলপ্রবাহ ধরে রাখতে সারা বছর ব্যারেজের ৫-৬টি গেট খুলে রাখা হবে।
কবির বিন আনোয়ার বলেন, তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে তিস্তায় আমাদের অংশের (বাংলাদেশ) নানামুখী উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে। তিন বছরের স্টাডি শেষে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। তিস্তা নিয়ে আমাদের অনেক পরিকল্পনা আছে।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কবির বিন আনোয়ার বলেন, ‘বর্ষাকালেও অনেক সময় তিস্তা শুকিয়ে যায়। এখানকার জেলে-মাঝিরাও তিস্তার মূলধারা চিনতে পারেন না। তিস্তার মূলধারাটি প্রবহমান করে তুলতে ব্যাপক খননই হবে তিস্তা মহাপরিকল্পনার মূল কাজ। ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হবে ড্রেজিংয়ের পেছনে। এবং খননের ফলে যে পরিমাণ মাটি পাওয়া যাবে তা দিয়ে নদীর দুই ধারে ১৭৪ কিলোমিটার ভূমি গঠিত হবে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনার একটি রূপকল্প তুলে ধরেন কবির বিন আনোয়ার। তিনি বলেন, নদীপারের ১৭৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আমরা ইকোপার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন, জনবসতি ও স্যাটেলাইট টাউন গড়ে তুলতে পারব। তিস্তা খননের ফলে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে যমুনার সঙ্গে সারা বছর একটি নৌ-কানেকটিভিটি সচল থাকবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক এ সিনিয়র সচিব বলেন, গত সাড়ে ৫ বছরে শুধু নর্থবেঙ্গলে ১২ হাজার কোটি টাকার কাজ হয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে। কুড়িগ্রামের রৌমারী-রাজিবপুরে দুটি প্রকল্প, ধরলা-দুধকুমার ও তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় প্রকল্প চালু আছে। ঢ্যাপা-পুনর্ভবায়ও প্রকল্প চলমান রয়েছে। মহানন্দা, করতোয়া, ফুলজোড় ও বাঙালি নদীতে খনন চালু আছে।
নদ-নদী খনন ও বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের কাজগুলো শেষ হতে কিছুটা সময় লাগলেও এর সুফল অদূর ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে দাবি করে তিনি বলেন, নদীর কাজ আসলে ভবন নির্মাণের মতো দ্রুত করে ফেলা যায় না। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বর্ষার জন্য কাজ করা যায় না। বসে থাকতে হয় শুষ্ক মৌসুম কখন আসবে সে অপেক্ষায়। বঙ্গোপসাগরে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার উপকূল অঞ্চলে জোয়ার-ভাটার হিসাব করে কাজ করতে হয়।
গত ১০ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার অন্তত ১৫ হাজার কিলোমিটার নদী খননের কাজ করেছে দাবি করে কবির বিন আনোয়ার বলেন, সাম্প্রতিককালে বন্যার প্রবণতা কমে এসেছে, এর কারণই হচ্ছে আমাদের নদ-নদীগুলোর ধারণক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।
বৃহত্তর রংপুরের ৫টি জেলায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটি গণদাবি জোরালো হয়ে উঠছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের কাছে এ নদীটি নিয়ে একটি প্রকল্প পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রস্তাবনা দিলে দেশটির ইয়োলো রিভার কোম্পানি নিজেদের খরচে দুই বছর ধরে সমীক্ষা শেষে প্রকল্পের একটি নকশা তৈরি করে। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি সবার নজর কাড়ে। কোভিড শুরুর আগেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিদেশি বিনিয়োগ পেতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠানো হলেও প্রকল্পের বাহ্যিক কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ভেতর থেকে অনেক উদ্যোগ থাকার পরও এ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না থাকা প্রসঙ্গে কবির বিন আনোয়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে আমি রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে দলীয় পর্যায়ে কাজ করছি। এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া আমার জন্য রিলেভেন্ট হবে না। তবে এটুকু বলতে পারি, শুধু ঘোষণা নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তিস্তা মহাপরিকল্পনা আমরা বাস্তবায়ন করে দেখাব।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়