আবু সাঈদ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা ভারতে গ্রেফতার

- Update Time : ০৬:৩০:১৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫
- / ২৬৩ Time View
ভারতে পালিয়েও শেষ রক্ষা হলো না রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. আরিফুজ্জামান আরিফের।
অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী কমিশনার (এএসপি) মো. আরিফুজ্জামান। তিনি রংপুরের আবু সাঈদ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।

ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তাকে গ্রেফতার করে থানায় সোপর্দ করেছে। তবে কীভাবে তাকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হবে সে বিষয়টি এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। তার বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনের ৩টি হত্যা ও ২টি হত্যা চেষ্টা মামলা রয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যায় আরিফুজ্জামান পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার স্বরূপনগর থানার অন্তর্গত এলাকার অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এসময় হাকিমপুর সীমান্ত চৌকিতে টহলরত বিএসএফ’এর ১৪৩ নম্বর ব্যাটেলিয়ানের সদস্যরা তাকে আটক করেন। এরপর শুরু হয় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ। পরে রাতেই তাকে স্বরূপনগর থানার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
এ সময় মো. আরিফুজ্জামানের কাছ থেকে বেশ কিছু পরিচয়পত্র, সরকারি নথি উদ্ধার করে ভারতীয় পুলিশ। তার বাড়ি বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার শাহীপাড়া এলাকায়।
সাতক্ষীরার কাকডাঙ্গা বিজিবি ক্যাম্পের সুবেদার কামরুজ্জামান জানান, শনিবার (২৩ আগস্ট) সন্ধ্যায় বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কাকডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার হাকিমপুর চেকপোস্ট পার হচ্ছিলেন তিনি। সেখান থেকে তাকে আটক করে বিএসএফ। তার পরিচয়পত্র দেখে সনাক্ত করা হয় যে তিনি বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান। বিএসএফ-এর হাতে আটকের পর তাকে এখন ভারতের স্বরূপনগর থানায় রাখা হয়েছে।
রংপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (হেডকোয়ার্টার্স) হাবিবুর রহমান জানান, আরিফুজ্জামানের বাড়ি নীলফামারীতে। গত বছর ৫ আগস্টের পর তাকে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা এপিবিএনে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বদলি করা হয়। এরপর থেকে তিনি পলাতক হন।
প্রসঙ্গত, গত বছর ১৪ আগস্ট বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগে মো. আরিফুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব নাসিমুল গণির সই করা এক প্রজ্ঞাপনে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও জানান, তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। ওই মামলায় ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জ গঠনের পর সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এর মধ্যে ৬ জন গ্রেফতার আছেন। এ ছাড়াও আরিফুজ্জামান রংপুর মহানগর তাজহাট থানায় শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলার (নং-০৩, তারিখ-১৯-০৮-২৪)-এর ৪ নম্বর আসামি; কোতোয়ালি থানায় কলা ব্যবসায়ী শহীদ মেরাজুল ইসলাম হত্যা মামলার (নং-১২, তারিখ-১৯-০৮-২৪)-এর ২১ নম্বর আসামি; একই থানায় সবজি ব্যবসায়ী শহীদ সাজ্জাদ হোসেন হত্যা মামলার (নং-১৪, তারিখ-২১-০৮-২৪)-এর ১৬ নম্বর আসামি। এছাড়াও কোতোয়ালি থানায় কলেজ শিক্ষার্থী জিম হত্যা চেষ্টা মামলার (নং-২৯, তারিখ-৩১-০৮-২৪)-এর ৫ নম্বর ও পল্লী চিকিৎসক জাহাঙ্গীর আলম সিদ্দিকী হত্যা চেষ্টা মামলার (নং-২৪, তারিখ-২০-১১-২৪)-এর ২ নম্বর আসামি তিনি।
রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মজিদ আলী জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। গত বছর ১৬ জুলাই জিলা স্কুল মোড় থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন ব্যাকোলজি মোড়ে শিক্ষার্থীদের মিছিল আটকে দিয়ে বেধড়ক লাঠিচার্জে নেতৃত্ব দেন তখনকার এসি আরিফুজ্জামান। এ ছাড়াও শহীদ আবু সাঈদকে গুলি করার আগে এবং পরে খুব কাছে থেকে নির্দেশ দেন আরিফ এবং নিজেও গুলি করেন।
দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, যেহেতু ভারতে গ্রেফতার হয়েছেন অনুপ্রবেশের দায়ে, সেখানে কি মামলা হয় সেটা আগে দেখতে হবে। এরপর এটা দুই দেশের মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। মন্ত্রণালয় টু মন্ত্রণালয় যোগাযোগ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। আমরা তার বিষয়ে মামলা এবং অন্যান্য নথিপত্র যথাযথভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রেরণ করেছি।
পুলিশসূত্র জানায়, গত বছর ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সিটি বাজার সামনে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে নিহত কলা ব্যবসায়ী সাজ্জাদ হোসেন হত্যা মামলায় বাদীর কাছ থেকে কৌশলে হলফনামা করিয়ে নাম কেটে দেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
গত বছর ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ক্যাপ্টেন ব্যাকোলজি মোড়ে পুলিশের হামলায় আহত ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহদি হাসান অনিক জানান, আন্দোলন দমাতে শুরু থেকেই এএসপি আরিফ শিক্ষার্থীদের ওপর মারমুখি ছিলেন। এমনকি তিনি খুব আগ্রাসী ভূমিকায় ছিলেন।
আরিফুজ্জামান ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলায় অবস্থিত এপিবিএন-২-এর সহকারী পুলিশ সুপার পদে কর্মরত ছিলেন। গত ১৪ অক্টোবর থেকে তিনি বিনা অনুমতিতে তার কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। এ কারণে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয় এবং সেই থেকে তিনি পলাতক ছিলেন।
এদিকে শনিবার সন্ধ্যায় এএসপি আরিফুজ্জামানকে আটকের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই তার পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। বিএসএফ ও স্থানীয় পুলিশের পক্ষ থেকেও গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়।
আরিফুজ্জামানের বিরুদ্ধে ১৪ (এ) ফরেনার্স আইন এবং ভারতীয় পাসপোর্ট আইনে (১২) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। আজ রোববার কড়া নিরাপত্তায় তাকে বসিরহাট মহকুমা আদালতে নেওয়া হলে ১৪ দিনের বিচার বিভাগীয় হেফাজতের (জেলহাজতে) নির্দেশ দেন অতিরিক্ত মুখ্য বিচারক।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত হন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী আবু সাঈদ। ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে। ছাত্রদের সবাই সরে গেলেও আবু সাঈদ লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে যান। এই অবস্থায় ৫০ ফুট দূর থেকে পুলিশ তার ওপর ছররা গুলি ছোড়ে। পুলিশের অবস্থানের জায়গাটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে। তারপরও অবস্থান থেকে সরেননি আবু সাঈদ। একপর্যায়ে কয়েকটি গুলি লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। অন্যান্য শিক্ষার্থীরা তাকে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তিনি মারা যান।
৪৮ বছর বয়সী আরিফুজ্জামান রংপুর মহানগর পুলিশের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (এএসপি) পদে কর্মরত ছিলেন। শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরই গা ঢাকা দেন আরিফুজ্জামান। নিজের কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি। কর্মস্থলে অনুপস্থিতির কারণে সম্প্রতি তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। জানা যায়, এ সময় সাতক্ষীরা এলাকায় আত্মগোপন করেছিলেন তিনি।