ঢাকা ০৪:২৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিটিভিনামা

আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ সচিব স্বামীর দাপটেই তাসমিনার উত্থান

বিশেষ প্রতিনিধি
  • Update Time : ০৬:২৫:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ নভেম্বর ২০২৪
  • / ৬৭ Time View

বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)’র উপ-মহাপরিচালক ড. সৈয়দা তাসমিনা আহমেদের পল্টি বাণিজ্য এখন মিডিয়া পাড়ার মুখরোচক ঘটনা। আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসিনের স্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ১৬ বছর শাসনে দাপটের সঙ্গে বিটিভিতে খবরদারি করেছেন। শেখ হাসিনার পতনের সাথে সাথে ভোল পাল্টেছেন। তিনি সরকারি কর্মকর্তা না হয়ে বরং অভিনেত্রী হলেই ভালো করতেন বলে সর্বমহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তাসমিনার স্বামী সাবেক সচিব মো. মোহসিনের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়। কিন্তু পতিত শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে তিনি তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে অবসরে গেছেন। একই ঘটনায় সাবেক সচিব শাহ কামাল কারাগারে থাকলেও মো. মহসিন বর্তমানে ভোল পাল্টে স্ত্রী তাসমিনার মাধ্যমে নিজেকে বাঁচানোর ফন্দি ফিকির করছেন।

বিটিভিতে ড. সৈয়দা তাসমিনা আহমেদের উত্থান তার সচিব স্বামীর যাদুকাঠির ছোঁয়ায় হয়েছে বলে বিটিভির সবাই জানে। দাপুটে স্বামীর প্রভাব খাটিয়ে সিনিয়রদের টপকে একাধিক প্রমোশন বাগিয়ে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি অল্পদিনের ব্যবধানে বার্তা সম্পাদক থেকে মূখ্য বার্তা সম্পাদক, তারপর পরিচালক (বার্তা) এবং বর্তমানে উপ-মহাপরিচালক (বার্তা) হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিনি ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবেও সুযোগ নিয়েছেন।

বিটিভির সংবাদকে আওয়ামী লীগের তোষামদকারি সংবাদ মাধ্যম বানানোর পেছনে তার কি কোনো দায় নেই? তারা স্বামী গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। আওয়ামী লীগের সিনিয়র সচিব হওয়া কি তিনি নিজ যোগ্যতায় হয়েছেন নাকি তেলবাজি-দলবাজি বা অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করে হয়েছেন? উপ-মহাপরিচালক (বার্তা) বিটিভির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যদি আওয়ামী লীগের সিনিয়র সচিবের স্ত্রী হয়েও বহাল তবিয়তে থাকতে পারেন। তাহলে নিম্নপদস্থ চুক্তিভিত্তিক রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত রিপোর্টাররা কেন চাকরিচ্যুত হবে। রিপোর্টার চাইলেই কখনোই তার ইচ্ছায় সংবাদ প্রচার করতে পারে না, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া। যারা হুকুমদাতা তারা কেন টিকে আছে বা থাকবে?

নওরোজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচিতে (সিপিপি) শতাধিক পদের নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ চিত্র পাওয়া যায়। প্রতিবেদন নিয়ে প্রায় এক পর বছর গড়িমসি করে শেষ পর্যন্ত নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করে মন্ত্রণালয়। তবে তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ মিললেও দায়ীদের বিরুদ্ধে এখনও নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। আর এ সুযোগে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন অভিযুক্তরা।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচিত, যোগ্য প্রার্থীর নম্বর কমিয়ে দেওয়া, উত্তরপত্র বদল, পছন্দের প্রার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। লিখিত পরীক্ষার খাতায় নম্বর কাটাকাটিরও প্রমাণ পাওয়া যায়।

২০২০ সালের ১৬ জুন ১০৮ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সিপিপি। ২০২১ সালের ২৮ আগস্ট লিখিত পরীক্ষার পর ৩০ আগস্ট ফল প্রকাশ হয়। মৌখিক পরীক্ষা শেষে ওই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশ হয় চূড়ান্ত ফল। এতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ সেপ্টেম্বর ফল স্থগিত করা হয়। এর পর অক্টোবরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব শেখ মো. মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে তদন্তের দায়িত্ব দেয় মন্ত্রণালয়। ১৩ মাস আগে কমিটির পক্ষ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিবের কাছে জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদন জমা হওয়ার অন্তত এক বছর পর এই জানুয়ারিতে নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করে মন্ত্রণালয়। তবে নিয়োগের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত সবাই আড়ালেই থেকে যায়।

মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সিপিপির নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে বেশ কয়েকজন জড়িত। এর মধ্যে বড় ভূমিকা রাখা দু’জন হলেন- সিপিপির প্রধান কর্মকর্তা আহমাদুল হক ও তৎকালীন সচিব মো. মোহসীন। অভিযোগ আছে, ওই সময় তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলেও ব্যবস্থা নেননি সচিব মো. মোহসীন। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন।

স্বামী সাবেক সচিব মোহসীনের পথ ধরে তাসমিনাও দূর্নীতিতে স্বিদ্ধহস্ত। বিটিভিকে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী এমপিদের প্রচার মাধ্যম করার পেছনে তৎকালীন মুখ্য বার্তা সম্পাদক হিসেবে তিনিই সর্বেসর্বা ছিলেন। তিনিই মূলত এর জন্য দায়ী। সেই সাথে বিটিভিকে অবৈধ পন্থায় লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করেছেন। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন হলেও এখনো বহাল তবিয়তে আছেন দাপুটে তাসমিনা। কিন্তু থলের বিড়াল বেরিয়েছে। নওরোজে প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাসমিনা নিজেকে বাঁচানোর জন্য দৌড়ঝাপ শুরু করেছন। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে না বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। (চলবে)

Please Share This Post in Your Social Media

বিটিভিনামা

আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ সচিব স্বামীর দাপটেই তাসমিনার উত্থান

বিশেষ প্রতিনিধি
Update Time : ০৬:২৫:০৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ নভেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)’র উপ-মহাপরিচালক ড. সৈয়দা তাসমিনা আহমেদের পল্টি বাণিজ্য এখন মিডিয়া পাড়ার মুখরোচক ঘটনা। আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসিনের স্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ১৬ বছর শাসনে দাপটের সঙ্গে বিটিভিতে খবরদারি করেছেন। শেখ হাসিনার পতনের সাথে সাথে ভোল পাল্টেছেন। তিনি সরকারি কর্মকর্তা না হয়ে বরং অভিনেত্রী হলেই ভালো করতেন বলে সর্বমহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তাসমিনার স্বামী সাবেক সচিব মো. মোহসিনের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়। কিন্তু পতিত শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে তিনি তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে অবসরে গেছেন। একই ঘটনায় সাবেক সচিব শাহ কামাল কারাগারে থাকলেও মো. মহসিন বর্তমানে ভোল পাল্টে স্ত্রী তাসমিনার মাধ্যমে নিজেকে বাঁচানোর ফন্দি ফিকির করছেন।

বিটিভিতে ড. সৈয়দা তাসমিনা আহমেদের উত্থান তার সচিব স্বামীর যাদুকাঠির ছোঁয়ায় হয়েছে বলে বিটিভির সবাই জানে। দাপুটে স্বামীর প্রভাব খাটিয়ে সিনিয়রদের টপকে একাধিক প্রমোশন বাগিয়ে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি অল্পদিনের ব্যবধানে বার্তা সম্পাদক থেকে মূখ্য বার্তা সম্পাদক, তারপর পরিচালক (বার্তা) এবং বর্তমানে উপ-মহাপরিচালক (বার্তা) হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিনি ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবেও সুযোগ নিয়েছেন।

বিটিভির সংবাদকে আওয়ামী লীগের তোষামদকারি সংবাদ মাধ্যম বানানোর পেছনে তার কি কোনো দায় নেই? তারা স্বামী গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। আওয়ামী লীগের সিনিয়র সচিব হওয়া কি তিনি নিজ যোগ্যতায় হয়েছেন নাকি তেলবাজি-দলবাজি বা অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করে হয়েছেন? উপ-মহাপরিচালক (বার্তা) বিটিভির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যদি আওয়ামী লীগের সিনিয়র সচিবের স্ত্রী হয়েও বহাল তবিয়তে থাকতে পারেন। তাহলে নিম্নপদস্থ চুক্তিভিত্তিক রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত রিপোর্টাররা কেন চাকরিচ্যুত হবে। রিপোর্টার চাইলেই কখনোই তার ইচ্ছায় সংবাদ প্রচার করতে পারে না, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া। যারা হুকুমদাতা তারা কেন টিকে আছে বা থাকবে?

নওরোজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচিতে (সিপিপি) শতাধিক পদের নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ চিত্র পাওয়া যায়। প্রতিবেদন নিয়ে প্রায় এক পর বছর গড়িমসি করে শেষ পর্যন্ত নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করে মন্ত্রণালয়। তবে তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ মিললেও দায়ীদের বিরুদ্ধে এখনও নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। আর এ সুযোগে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন অভিযুক্তরা।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচিত, যোগ্য প্রার্থীর নম্বর কমিয়ে দেওয়া, উত্তরপত্র বদল, পছন্দের প্রার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। লিখিত পরীক্ষার খাতায় নম্বর কাটাকাটিরও প্রমাণ পাওয়া যায়।

২০২০ সালের ১৬ জুন ১০৮ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সিপিপি। ২০২১ সালের ২৮ আগস্ট লিখিত পরীক্ষার পর ৩০ আগস্ট ফল প্রকাশ হয়। মৌখিক পরীক্ষা শেষে ওই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশ হয় চূড়ান্ত ফল। এতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ সেপ্টেম্বর ফল স্থগিত করা হয়। এর পর অক্টোবরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব শেখ মো. মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে তদন্তের দায়িত্ব দেয় মন্ত্রণালয়। ১৩ মাস আগে কমিটির পক্ষ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিবের কাছে জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদন জমা হওয়ার অন্তত এক বছর পর এই জানুয়ারিতে নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করে মন্ত্রণালয়। তবে নিয়োগের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত সবাই আড়ালেই থেকে যায়।

মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সিপিপির নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে বেশ কয়েকজন জড়িত। এর মধ্যে বড় ভূমিকা রাখা দু’জন হলেন- সিপিপির প্রধান কর্মকর্তা আহমাদুল হক ও তৎকালীন সচিব মো. মোহসীন। অভিযোগ আছে, ওই সময় তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলেও ব্যবস্থা নেননি সচিব মো. মোহসীন। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন।

স্বামী সাবেক সচিব মোহসীনের পথ ধরে তাসমিনাও দূর্নীতিতে স্বিদ্ধহস্ত। বিটিভিকে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী এমপিদের প্রচার মাধ্যম করার পেছনে তৎকালীন মুখ্য বার্তা সম্পাদক হিসেবে তিনিই সর্বেসর্বা ছিলেন। তিনিই মূলত এর জন্য দায়ী। সেই সাথে বিটিভিকে অবৈধ পন্থায় লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করেছেন। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন হলেও এখনো বহাল তবিয়তে আছেন দাপুটে তাসমিনা। কিন্তু থলের বিড়াল বেরিয়েছে। নওরোজে প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাসমিনা নিজেকে বাঁচানোর জন্য দৌড়ঝাপ শুরু করেছন। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে না বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। (চলবে)